ভারতীয় জীবনত্রাণ-সমাজের মহাপ্রয়াণে
(শচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য-কে) |
অকস্মাৎ মধ্যদিনে গান বন্ধ ক’রে দিল পাখি, ছিন্নভিন্ন সন্ধ্যাবেলা প্রাত্যহিক মিলনের রাখী; ঘরে ঘরে অনেকেই নিঃসঙ্গ একাকী৷ ক্লাব উঠে গিয়েছে সফরে, শূন্য ঘর, শূন্য মাঠ, ফুল ফোটা মালঞ্চ প’ড়ে ত্যক্ত এ ক্লাবের কক্ষে নিষ্প্রদীপ অন্ধকার নামে৷ সূর্য অস্ত গিয়েছে কখন, কারো আজ দেখা নেই— কোথাও বন্ধুর দল ছড়ায় না হাসি, নিষ্প্রভ ভোজের স্বপ্ন; একটি কথাও শব্দ তোলে না বাতাসে— ক্লাব-ঘরে ধুলো জমে, বিনা গল্পে সন্ধ্যা হয়; চাঁদ ওঠে উন্মুক্ত আকাশে৷ খেলোয়াড় খেলে নাকো, গায়কেরা গায় নাকো গান— বক্তারা বলে না কথা সাঁতারুর বন্ধ আজ স্নান৷ সর্বস্ব নিয়েছে গোরা তারা মারে ঊরুতে চাপড়, যে পথে এ ক্লাব গেছে কে জানে সে পথের খবর? সন্ধ্যার আভাস আসে, জ্বলে না আলোক ক্লাব কক্ষের কোলে, হাতে হাতে নেই সিগারেট— তর্কাতর্কি হয় নাকো বিভক্ত দু’দলে; অযথা সন্ধ্যায় কোনো অচেনার পদশব্দে মালীটি হাঁকে না৷ |
মনে পড়ে লেকের সে পথ? মনে পড়ে সন্ধ্যাবেলা হাওয়ার চাবুক৷ অনেক উজ্জ্বল দৃশ্য এই লেকে করেছিল উৎসাহিত বুক৷ কেরানী, বেকার, ছাত্র, অধ্যাপক, শিল্পী ও ডাক্তার সকলের কাছে ছিল অবারিত দ্বার, কাজের গহ্বর থেকে পাখিদের মতো এরা নীড় সন্ধানে, সন্ধ্যায় ডেকে এনেছিল এইখানে ভিড়৷ রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য ও সিনেমার কথা, এদের রসনা থেকে প্রত্যহ স্খলিত হ’তে অলক্ষ্যে অযথা; মাঝে মাঝে অনর্থক উচ্ছ্বসিত হাসি, বাতাসে ছড়াত নিত্য শব্দ রাশি রাশি৷ তারপর অকস্মাৎ ভেঙে গেল রুদ্ধশ্বাস মন্ত্রমুগ্ধ সভা, সহসা চৈতন্যোদয়; প্রত্যেকের বুকে ফোটে ক্ষুব্ধ রক্তজবা; সমস্ত গানের শেষে যেন ভেঙে গেল এক গানের আসর, যেমন রাত্রির শেষে নিঃশ্বেষে কাঙাল হয় বিবাহ-বাসর৷ ‘জীবন-রক্ষক’ এই সমাজের দারুণ অভাবে, এদের ‘জীবন-রক্ষা’ হয়তো কঠিন হবে, হয়তো অনেক প্রাণ যাবে॥ |