তারুণ্য |
হে তারুণ্য, জীবনের প্রত্যেক প্রবাহ অমৃতের স্পর্শ চায়; অন্ধকারময় ত্রিকালের কারাগৃহ ছিন্ন করি’ উদ্দাম গতিতে বেদনা-বিদ্যুৎ-শিখা জ্বালাময় আত্মার আকাশে, ঊর্ধ্বমুখী আপনারে দগ্ধ করে প্রচণ্ড বিস্ময়ে। জীবনের প্রতি পদপে তাই বুঝি ব্যাথাবিদ্ধ বিষণ্ণ বিদায়ে। রক্তময় দ্বিপ্রহরে অনাগত সন্ধ্যার আভাসে তোমার অক্ষয় বীজ অঙ্কুরিত যবে বিষ-মগ্ন রাত্রিবেলা কালের হিংস্রতা কণ্ঠরোধ করে অবিশ্বাসে। অগ্নিময় দিনরাত্রি মোর; আমি যে প্রভাতসূর্য স্পর্শহীন অন্ধকারে চৈতন্যের তীরে উন্মাদ, সন্ধান করি বিশ্বের বন্যায় সৃষ্টির প্রথম সুর। বজ্রের ঝংকারে প্রচণ্ড ধ্বংসের বার্তা আমি যেন পাই। মুক্তির পুলক-লুব্ধ বেগে একী মোর প্রথম স্পন্দন! আমার বক্ষের মাঝে প্রভাতের অস্ফুট কাকলি, হে তারুণ্য, রক্তে মোর আজিকার বিদ্যুৎ-বিদায় আমার প্রাণের কণ্ঠে দিয়ে গেল গান; বক্ষে মোর পৃথিবীর সুর। উচ্ছ্বসিত প্রাণে মোর রোমাঞ্চিত আদিম উল্লাস। আমি যেন মৃত্যুর প্রতীক। তাণ্ডবের সুর যেন নৃত্যময় প্রতি অঙ্গে মোর, সম্মুখীন সৃষ্টির আশ্বাসে। মধ্যাহ্নের ধ্যান মোর মুক্তি পেল তোমার ইঙ্গিতে। তারুণ্যের ব্যর্থ বেদনায় নিমজ্জিত দিনগুলি যাত্রা করে সম্মুখের টানে। নৈরাশ্য নিঃশ্বাসে ক্ষত তোমার বিশ্বাস প্রতিদিন বৃদ্ধ হয় কালের কর্দমে। হৃদয়ের সূক্ষ্ম তন্ত্রী সঙ্গীত বিহীন, আকাশের স্বপ্ন মাঝে রাত্রির জিজ্ঞাসা ক্ষয় হয়ে যায়। নিভৃত ক্রন্দনে তাই পরিশ্রান্ত সংগ্রামের দিন। বহ্নিময় দিনরাত্রি চক্ষে মোর এনেছে অন্তিম। ধ্বংস হোক, লুপ্ত হোক ক্ষুদিত পৃথিবী আর সর্পিল সভ্যতা। ইতিহাস স্তুতিময় শোকের উচ্ছ্বাস, তবু আজ তারুণ্যের মুক্তি নেই, মুমূর্ষু মানব। প্রাণে মোর অজানা উত্তাপ অবিরাম মুগ্ধ করে পুষ্টিকর রক্তের সঙ্কেতে! পরিপূর্ণ সভ্যতা সঞ্চয়ে আজ যারা রক্তলোভী বর্ধিত প্রলয় অন্বেষণে, তাদের সংহার করো মৃতের মিনতি। অন্ধ তমিস্রার স্রোতে দূরগামী দিন আসন্ন রক্তের গন্ধে মূর্ছিত সভয়ে। চলেছে রাত্রির যাত্রী আলোকের পানে দূর হতে দূরে। বিফল তারুণ্য-স্রোতে |
জরাগ্রস্ত কিশলয় দিন। নিত্যকার আবর্তনে তারুণ্যের উদ্গত উদ্যম বার্ধক্যের বেলাভূমি ’পরে অতর্কিতে স্তব্ধ হয়ে যায়। তবু, হায়রে পৃথিবী, তারুণ্যের মর্মকথা কে বুঝাবে তোরে! কালের গহ্বরে খেলা করে চিরকাল বিস্ফোরণহীন। স্তিমিত বসন্তবেগ নিরুদ্দেশ যাত্রা করে জোয়ারের জলে। অন্ধকার, অন্ধকার, বিভ্রান্ত বিদায়; নিশ্চিত ধ্বংসের পথে ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবী। বিকৃত বিশ্বের বুকে প্রকম্পিত ছায়া মরণের, নক্ষত্রের আহ্বানে বিহ্বল তারুণ্যের হৃৎপিণ্ডে বিদীর্ণ বিলাস। ক্ষুব্ধ অন্তরের জ্বালা, তীব্র অভিশাপ; পর্বতের বক্ষমাঝে নির্ঝর-গুঞ্জনে উৎস হতে ধবমান দিক্-চক্রবালে। সম্মুখের পানপাত্রে কী দুর্বার মোহ, তবু হায় বিপ্রলব্ধ রিক্ত হোমশিখা! মত্ততায় দিক্ভ্রান্তি, প্রাণের মঞ্জরী দক্ষিণের গুঞ্জরণে নিষ্ঠুর প্রলাপে অস্বীকার করে পৃথিবীরে। অলক্ষিতে ভূমিলগ্ন আকাশ কুসুম ঝরে যায় অস্পষ্ট হাসিতে। তারুণ্যের নীলরক্ত সহস্র সূর্যের স্রোতে মৃত্যুর স্পর্ধায় ভেসে যায় দিগন্ত আঁধারে। প্রত্যুষের কালো পাখি গোধূলির রক্তিম ছায়ায় আকাশের বার্তা নিয়ে বিনিদ্র তারার বুকে ফিরে গেল নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়। দিনের পিপাসু দৃষ্টি, রাত্রি ঝরে বিবর্ণ পথের চারিদিকে। ভয়ঙ্কর দিনরাত্রি প্রলয়ের প্রতিদ্বন্দ্বে লীন; তারুণ্যের প্রত্যেক আঘাতে কম্পমান উর্বর-উচ্ছেদ। অশরীরী আমি আজ তারুণ্যের তরঙ্গের তলে সমাহিত উত্তপ্ত শয্যায়। ক্রমাগত শতাব্দীর বন্দী আমি অন্ধকারে যেন খুঁজে ফিরি অদৃশ্য সূর্যের দীপ্তি উচ্ছিষ্ট অন্তরে। বিদায় পৃথিবী আজ, তারুণ্যের তাপে নিবদ্ধ পথিক-দৃষ্টি উদ্বুদ্ধ আকাশে, সার্থক আমার নিত্য-লুপ্ত পরিক্রমা ধ্বনিময় অনন্ত প্রান্তরে। দূরগামী আমি আজ উদ্বেলিত পশ্চাতের পানে উদাস উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি রেখে যাই সম্মুখের ডাকে। শাশ্বত ভাস্বর পথে আমার নিষিদ্ধ আয়োজন, হিমাচ্ছন্ন চক্ষে মোর জড়তার ঘন অন্ধকার। হে দেবতা আলো চাই, সূর্যের সঞ্চয় তারুণ্যের রক্তে মোর কী নিঃসীম জ্বালা! অন্ধকার অরণ্যের উদ্দাম উল্লাস লুপ্ত হোক আশঙ্কায় উদ্ধত মৃত্যুতে॥ |